Subhash Bhowmick: স্বপ্ন দেখা সুভাষই সাবালক করেছিলেন ভারতীয় ফুটবলকে
সুভাষ কি শুধুই ফুটবলারদের ‘অভিভাবক’ ছিলেন? বলা উচিত, কোচ সুভাষ ভারতীয় ফুটবলকেও সাবালক করেছিলেন তাঁর ইচ্ছে, তাগিদ, স্বপ্ন দিয়ে। আশিয়ান কাপে খেলার প্রস্তাব পেয়ে লুফে নিয়েছিলেন সুভাষ। আগের মরসুমে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টিম।
অভিষেক সেনগুপ্ত
সরাসরি বাড়িতেই ফোন করে বসলেন তিনি। তখন ল্যান্ডলাইনের যুগ। কে ঘরে, কে বাইরে, সহজেই বোঝা যেত। বিকেলে কড়া নির্দেশও দিয়েছিলেন, রান দশটার পর বাড়ির বাইরে নয়। শৃঙ্খলা না থাকলে কেউ বড় হতে পারে না।
যাঁকে ফোন করেছিলেন, তখনও তিনি বাড়ি ফেরেননি। তাঁর মাকে বললেন, ‘ও যেন ফিরেই আমাকে ফোন করে।’ রাত দশটা বাজলে এমন অনেকের বাড়িতে ফোন যেত তাঁর। কে কোথায় আছেন, রাতে কী খেলেন, সকালে কী খাবেন— সব দিকে কড়া নজর ছিল। কোচ ছিলেন তিনি। কিন্তু কোচের আবর্ত থেকে বেরিয়ে হয়ে উঠেছিলেন অভিভাবক। টিমের ফুটবলারদের কাছে বাবা।
শনিবার সকালে প্রিয় ময়দান, লাল-হলুদ ড্রেসিংরুম, সবুজ-মেরুন লন ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেলেন সুভাষ ভৌমিক (Subhash Bhowmick)। বর্ণময় ফুটবলার জীবন এখনও ভাসছে ময়দানের চোখে। ততধিক রঙিন কোচিং কেরিয়ারও।
সুভাষ কেন কোচের সীমানা ছাড়িয়ে অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন? গুরু প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। তাঁকেই দেখেই শিখেছিলেন, কোচ আসলে ফুটবল শেখান না। জীবন তৈরির কারিগর তিনি। পিকের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন, ফুটবলের বাইরে জীবনে জড়িয়ে যেতে না পারলে ফুটবলার চিনতে পারবেন না। তাঁর সেরাটাও বের করে আনতে পারবেন না। তাই সুভাষকে ‘স্যার’ বললেও দেবজিৎ ঘোষ, বিজেন সিং, আলভিটো ডি’কুনহা, দীপঙ্কর রায়রা তাঁকে ‘বাবা’ বলেই জানতেন। কোচ থেকে অভিভাবকে উত্তীর্ণ হতে পারাটাই সুভাষের কোচিং জীবনে সবচেয়ে বড় সাফল্য।
খবর শুনেই একবালপুরের হাসপাতালে ছুটেছেন দেবজিৎ। সেখান থেকেই ফোনে বললেন, ‘মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে আসার পিছনে লোকটার বিরাট অবদান ছিল। তখন সুভাষদা মহমেডানে নিয়ে গিয়েছেন। আমার মেয়ে তখন ছোট্ট। আমি বাড়ির বাইরে বেরলেই ওর জ্বর এসে যেত। হলদিয়ায় তখন ক্যাম্পে রয়েছি। সুভাষদা প্র্যাক্টিসের পর বললেন, ‘শোন তুই তোর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে চলে আয়। তোর সঙ্গে ওরা ভালো থাকবে।’ প্লেয়ারদের খুঁটিনাটি সব বিষয়ে নজর থাকলে এমন বলতে পারে কেউ!’ মণিপুরের বিজেন মেসে থাকতেন। তারকা পাহাড়ি ফুটবলারের খাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। তাঁকে ডেকে সুভাষ বললেন, ‘তুই আমার বাড়িতে থাক। তোর সমস্যা হবে না।’ চোটে পড়েছেন আলভিটো। ঠিকঠাক রিহ্যাব হচ্ছে না। তাঁকে বাড়িতে ডেকে নিলেন। শুধু তাই নয়, ষষ্ঠী দুলে, দীপঙ্কর রায়রা পুলিশি কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন শুনে তিনিই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দুই ছাত্রকে বাঁচাতে। দীপঙ্কর বলছিলেন, ‘ওই ঘটনার পর সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা হয়তো হারিয়েই যেতাম। যদি না বাবার মতো পাশে থাকতেন সুভাষ স্যার। জামিন পাওয়ার পর সরাসরি কল্যাণীতে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আমাদের। তখন ক্যাম্প চলছে। ওখানে থেকেই টিম কলকাতা লিগও খেলছে। ক্যাম্পে যাওয়ার পর সুভাষ স্যার আমাদের ডেকে বলেছিলেন, ‘ভুল মানুষে করে। কিন্তু ভুল শুধরে যে এগিয়ে যেতে পারে, সেই সাফল্য পায়। তোদের সামনে ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ আছে। সব ভুলে সামনে তাকা।’
সুভাষ কি শুধুই ফুটবলারদের ‘অভিভাবক’ ছিলেন? বলা উচিত, কোচ সুভাষ ভারতীয় ফুটবলকেও সাবালক করেছিলেন তাঁর ইচ্ছে, তাগিদ, স্বপ্ন দিয়ে। আশিয়ান কাপে খেলার প্রস্তাব পেয়ে লুফে নিয়েছিলেন সুভাষ। আগের মরসুমে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টিম। ভারতের সেরা ফুটবলার তাঁর টিমে। কিন্তু বিদেশের কোনও টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে শুধু যে টিম দিয়ে হবে না, ভালোই জানতেন। দরকার দারুণ প্রস্তুতি। তখনও ভারতীয় ফুটবলে ‘প্রিসিজন’ শব্দটার জন্ম হয়নি। যতটুকু প্রাক মরসুম প্রস্তুতি, ক্লাবের মাঠেই হত। ইস্টবেঙ্গল মাঠের অসমান মাঠে যে কোনও সময় চোট লেগে যেতে পারে। কলকাতা লিগ খেলা যায় সেখানে, বিদেশের টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। সুভাষ তদ্বির করতে শুরু করলেন নানা জায়গায়। সরকারি থেকে ব্যবসায়ী সহ মহলেই ছিল অবাধ গতিবিধি। তাই কাজে লাগিয়ে হায়াত হোটেলে থেকে একমাসের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। প্র্যাক্টিস যুবভারতীতে। পাঁচতারা হোটেলে থেকে কোনও ভারতীয় টিম কখনও প্রি সিজন করেছে, এমন ঘটনা তার আগে ঘটেনি। সুভাষের সঙ্গে যতবার আশিয়ান জয় নিয়ে কথা হয়েছে, মাথা দোলাতে দোলাতে বলেছেন, ‘সাফল্য সবাই দেখতে পায়। কিন্তু সাফল্যের প্রাক মুহূর্তগুলোর খবর লোকে রাখে না। পাঁচতারা হোটেলে ওই যে ট্রেনিংটা করেছিলাম, সেটাই টিমকে অন্য রকম স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে দিয়েছিল।’
স্বপ্ন সুভাষ দেখতেন। সুভাষ স্বপ্ন দেখাতেনও। ইস্টবেঙ্গলের দুটো, চার্চিলের একটা আই লিগ, আশিয়ান জয় দিয়েও কোচ সুভাষকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। সুভাষকে চিনতে হলে যেতে হবে তাঁর ছাত্রদের কাছে। যাঁরা চোখের জলে বিদায় জানালেন ‘বাবা’কে।