‘রিয়া কী করতে চান, কী করতে চান না—তা তিনিই নির্ধারণ করবেন, সমাজ অথবা পুরুষ নয়’

রিয়া চক্রবর্তী—সুশান্ত সিং রাজপুতের শেষ দিককার লিভ-ইন পার্টনারের টি-শার্টের গায়ে লেখা 'স্ম্যাশ পেট্রিয়ার্কি' শব্দ দু'টো নিয়ে দেশজুড়ে প্রচুর আলোচনা হয়‌ গতবছর। Sushant Singh Rajput death anniversary-তে আজ বিশ্লেষণ রিয়ার সেই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা প্রতিবাদের ইচ্ছে নিয়ে।  

'রিয়া কী করতে চান, কী করতে চান না—তা তিনিই নির্ধারণ করবেন, সমাজ অথবা পুরুষ নয়'
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jun 14, 2021 | 11:29 AM

এই লেখাটি দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী, যিনি বর্তমানে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স এবং নারীবিদ্যার গবেষক, তাঁর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অনুলিখিত 

গত বছর করোনা যখন আমাদের দেশে আছড়ে পড়ল, তার কয়েক মাসের মধ্যে আরও একটি খবর প্রায় করোনার মতোই গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিল। আর তা হল বলিউডের একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান উজ্জ্বল তারকার অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর, যাঁর নাম সুশান্ত সিং রাজপুত। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুতে যে আইনি তদন্ত বা আইনি গতিপ্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলার আশা আমরা রাখতে পারতাম, সেটা কোথাও না কোথাও গিয়ে সাংঘাতিকভাবে ধাক্কা খেল যখন এই তদন্তের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া পর্যবসিত হল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বিশেষত, তাঁর জীবনে মহিলাদের উপস্থিতি নিয়ে টানা হ্যাঁচড়ায়। এবং এখানে সবথেকে বেশি যাঁকে নিয়ে আক্রমণ শুরু হল, তিনি হলেন সুশান্ত সিং রাজপুতের শেষ দিককার লিভ-ইন পার্টনার রিয়া চক্রবর্তী। আমরা দেখেছি রিয়াকে কী ভয়ঙ্কর সামাজিক ক্রোধের শিকার হতে হয়েছে, কী অবলীলায় তাঁকে ‘ডাইনি’ তকমা দেওয়া হয়েছে, নানা কদর্য সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনিই শুধু নন, তাঁর পরিবারের সবাইকে এই ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে… তিনি জেল খেটেছেন, জেল খাটতে হয়েছে তাঁর ভাই শৌভিককেও।

রিয়াকে আমি চিনি না, ব্যক্তিগতভাবে জানি না। তাঁকে যেটুকু টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি আমার মনে হয়েছে, এই যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা অর্থাৎ পুরুষের সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পিছনে একজন নারীকে দায়ী করার প্রবণতা, নারীর চরিত্র এবং জীবনযাপন নিয়ে আঙুল তুলে দেওয়া—এর বিরুদ্ধে রিয়ার সটান বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা প্রতিবাদের যে ইচ্ছা, সেটা তারিফযোগ্য। মনে হয়েছিল, উনি কোথাও গিয়ে এই লড়াইটা করতে চাইছেন।

আরও পড়ুন:  সুশান্ত সিং রাজপুত মৃত্যুবার্ষিকী—ফিরে দেখা

এ রকমই একটা সময়ে রিয়া একটি টি-শার্ট পরেছিলেন, যে টি-শার্টে ‘স্ম্যাশ পেট্রিয়ার্কি’ শব্দ দু’টো লেখা ছিল এবং সময়ের নিয়ম মেনে তখন ওই টি-শার্টের গায়ে লেখা দুই শব্দ নিয়ে দেশজুড়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর আলোচনা হয়‌। সেই আলোচনার বাইরে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল খুব সাটল্ একটা বার্তা দিয়ে দিলেন রিয়া, একটা নীরব মেসেজ। উচ্চকিত কণ্ঠে চিৎকার চেঁচামেচি না করে, সভায়-পদযাত্রায় মোমবাতি হাতে কিছু না বলেও রিয়া নিঃশব্দে যা করলেন স্রেফ একটি পোশাকের মাধ্যমে, তা দেখে আমার মনে হয়েছিল তাঁর ওই পদক্ষেপ এমন অনেক মহিলাকে সাহস জোগাবে, যাঁরা জোর গলায় খোলাখুলি কথা বলতে পারেন না। কারণ তাঁদের সেই জায়গাটাই নেই, কিন্তু প্রতিবাদ তাঁরাও করতে চান। আমার ভাল লেগেছিল রিয়ার এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ধরন।

তবে আমার আলোচনার উপজীব্য এটি নয়। আমি দৃষ্টি ঘোরাতে চাইব অন্য একটি দিকে—এই বছর একটি সর্বভারতীয় মিডিয়ার দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মহিলাদের নিয়ে তৈরি একটি তালিকায় রিয়ার নাম উঠে এসেছে একেবারে প্রথম দিকে উঠে এবং আবার যথারীতি তাঁকে নিয়ে প্রচুর আলোচনা শুরু হয়েছে। কী করে এ রকম চরিত্রহীন-ডাইনি মহিলা এই তালিকায় জায়গা পান ইত্যাদি… আমি সে কথায় যাচ্ছি না, কারণ সেটি চর্বিত-চর্বণ হয়ে যাবে।

তবে এই গোটা ঘটনায় আমাকে যে ব্যাপারটি আকর্ষণ করেছে তা হল এ বিষয়ে রিয়ার নীরবতা। গত বছর মিডিয়া যখন তাঁকে আক্রমণ করে, তখন যে রিয়াকে আমরা দেখেছি, এই বার এই তালিকার বিষয়ে তাঁর নীরব থাকাটা আমি ধরে নিচ্ছি রিয়ার চয়েস। বা বলা ভাল, ইচ্ছেভিত্তিক সিদ্ধান্ত (চয়েস বেসড ডিসিশন)। এবং আমরা যাঁরা নারীর অধিকার নিয়ে চর্চা করি তাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি একজন মহিলার সবসময় এই অধিকার থাকা উচিত। তিনি কী করতে চান, কী করতে চান না—তা তিনিই নির্ধারণ করবেন, সমাজ অথবা পুরুষ নয়।

আরও পড়ুন:  সুশান্ত সিং রাজপুতকে খোলা চিঠি লিখলেন তাঁর সহ-অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়

আমি ধরে নিচ্ছি, এ ক্ষেত্রে রিয়া প্রতিক্রিয়া না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা তাঁর নিজের অধিকারের মধ্যে পড়ে। আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। আমার আপত্তিটা হল রিয়া বা রিয়ার মতো যাঁরা, তাঁরা যদি বুঝতে না চান বা বুঝতে না পারেন যে, এই যে আকর্ষণীয়তার তালিকা এবং তার যে মাপকাঠিগুলো, কার শরীরের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স কতো, তাঁকে নিয়ে গুগলে ঠিক কতটা সার্চ হয়েছে অথবা তাঁকে পুরুষরা ঠিক কতটা চেয়েছেন বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে… তার ভিত্তিতে এই যে মহিলা শরীরকে তালিকাবদ্ধ করা, সেটাও যে এক নারী এবং তাঁর জীবন যাপনের বিপণন… এইটা যখন আমরা বুঝতে না চাই অথবা বুঝতে পারি না, তখন আমার অসুবিধে হয়। কারণ, বাজার অর্থনীতি, বিপণনের অর্থনীতি, মহিলা শরীরকে বিক্রি করার অর্থনীতি যে পুরোপুরি পুরুষতন্ত্র দ্বারা নির্ধারিত, এটা বুঝতে রিয়ার মতো সচেতনাদের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। রিয়ারা যদি সেটা বুঝতে না চান, আমি সেখানেও বলব সেটাও তাঁদের অধিকারের মধ্যে পড়ে।

কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটা কোথাও গিয়ে বিপদের সঙ্কেত এনে দেয় যে পেশাগত বাধ্যবাধকতার কারণে বা সামাজিক বাধ্যবাধ্যকতার কারণে, আমরা কিছু ক্ষেত্রে চুপ থাকি এবং কিছু ক্ষেত্রে থাকি না এবং এই যে আমাদের বেছে নেওয়া—সিলেক্টিভ প্রটেস্ট… প্রতিবাদ কখনও করব আবার কখনও করব না আমার সুবিধা অনুযায়ী… আমি ভ্যালু জাজমেন্টে যাচ্ছি না, রিয়া ঠিক না ভুল সেই বিচারও করছি না, কিন্তু পুরো ঘটনাকে আরও বড় করে দেখাতে চাইছি এইটা বলতে যে, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা সার্বিক হওয়া দরকার।

আরও পড়ুন:  SSR Case: কী কী ঘটল এক বছরে, কোথায় দাঁড়িয়ে মামলা, সুশান্তের মৃত্যুবার্ষিকীতে ফিরে দেখা ঘটনাপ্রবাহ

বলা উচিত আমি কোনওভাবেই পণ্য নই অথবা বিপণনযোগ্য নই। আমাকে যখন ডাইনি বলা হয়, একটি পুরুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় আইনের বাইরে গিয়ে, আমাকে যখন নীতিমালার গল্প শুনিয়ে হেনস্থা করা হয় তখন সে সময়ে আমি যেভাবে প্রতিবাদ করি ঠিক সেইভাবেই আমার প্রতিবাদ করা দরকার যখন আমাকে পণ্য হিসেবে এই পুরুষতন্ত্র তাঁদের সুবিধে অনুযায়ী বিক্রি করে। অবশ্য রিয়া তাঁর জীবনকে কোন গতিস্রোতে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সেটি সম্পূর্ণ তাঁর অধিকার। রিয়া এবং তাঁর মতো সকলের জন্য আমরা শুধু এইটুকুই আশা করব আইন, সমাজ তাঁদের নিজস্ব পথে চলবে এবং প্রত্যেককে সুস্থ ভাবে বাঁচার একটা জায়গা করে দেবে‌।

আরও পড়ুন: সুশান্তের ব্যক্তিজীবন নিয়েও তো বহু চর্চা হয়েছে… কিন্তু সত্যিটা তো জানা যাবে না: সন্দীপ্তা সেন

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস