ঠিকানা, ৭এ রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার হলেও অক্রূর দত্ত লেনের ওপরে প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই ছোট্ট চায়ের দোকানটা। পাওয়া যায় দুধ-চা, লিকার-চা, বিস্কুট, ব্রেড টোস্ট, ডিম সিদ্ধ। দোকানের মালিক অকুল কুণ্ডু তাঁর যৌবন থেকে চালাচ্ছেন এই টি-স্টল।
এই দোকান থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ছিল কৃত্তিবাসের দপ্তর। চায়ের টানে এই দোকানে বারবার এসেছেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী, উৎপল কুমার বসু থেকে কৃত্তিবাস সাহিত্য পত্রিকার অনেকেই। বারবার অকুলের দোকানে চায়ের জন্য হাঁক পাড়তেন কবিরা। আবার এই অক্রূর দত্ত লেনেই ছিল হিন্দুস্থান রেকর্ডের অফিস। তাই-ই মান্না দে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উষা উত্থুপেরও আনাগোনা ছিল এই টি-স্টলে।
সুনীল, শক্তিরা চায়ের অর্ডারই দিতেন বেশি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সুরাপ্রেম সর্বজনবিদিত। সেই আসরও বহুবার চাক্ষুস করেছেন যুবক অকুল। প্রায়শই মৌতাতের পর শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মিনিবাসে তুলে দিয়ে আসতেন তরুণ অকুল। আজও তাঁর স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল সেই সময়। অকুল আজও মনে করে বিহ্বল হয়ে পড়েন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখার দিনটি। আর ছিল ভিয়েস্তাস আর্দেশির বালসারার নিত্য আনাগোনা।
ভি বালসারা ছিলেন অকুলের 'বালসারাদ'। চা,ডিম সিদ্ধ আর ব্রেড টোস্ট দিয়ে দিন শুরু করতেন বালসারা এই দোকানেই। একবার একটি সংবাদপত্রে এই চায়ের দোকান সম্বন্ধে লিখেওছিলেন ভি বালসারা। আজও সেই কাগজ অমূল্য এক সংগ্ৰহ হিসাবে রেখে দিয়েছেন অকুল। হলদে হয়ে যাওয়া সেই নিউজপ্রিন্টে আজও জ্বলজ্বল করছে , "আমার চায়ের দোকান, ৪০ বছর কেটে গেল অকুলের দোকানে।"
ছাকনি, ধোঁয়া ওঠা কেটলি, আর কয়লার আগুনে রোজ এভাবেই রোজ মহানগরীর ভোরের কবিতা লিখে চলেছেন অকুল কুণ্ডু। ছোট্ট দোকান লাগোয়া কংক্রিটের চাতালে এসে জড়ো হন চায়ের অনুরাগীরা। দু'টি পাতা একটি কুঁড়ির রসায়নে জারিত হয় রাজনীতি, খেলা থেকে প্রাত্যহিক খবরের শিরোনামে থাকা সমস্ত বিষয়গুলো।
আজ অকুলের শরীরে বয়সের ছাপ। যে সময় গিয়েছে চলে তার দিকে আজও অপলকে চেয়ে থাকেন প্রৌঢ় অকুল। আক্ষেপ করে বলেন, "কী সব দিন ছিল! কী সব মানুষ ছিল!" ব্যক্তিগত জীবনেও নানা প্রতিকূল সময়ে বালসারা, সুনীল কিংবা শক্তির সাহায্য পেয়েছেন এই চা-বিক্রেতা। আজ ভেবে অবাক হন কী সহজ ভাবে তাঁকে কাছে টেনে নিয়ে সব ভেদাভেদ ভুলে যেন পরিবারের একজনই করে নিয়েছিলেন ওই প্রবাদপ্রতিম মানুষগুলি।
অকুলের দুই সন্তান ছেলে অভিজিৎ ভূগোলে স্নাতক। সে-ও বাবার কাজে সহায়তা করে এই দোকানে। বাবার মুখে শুনেছে বাংলা সংস্কৃতির দিকপালদের কথা। অভিজিৎ রোমাঞ্চিত হয়েছে এই ভেবে যে তাঁর বাবা ওই সব দিকপাল মানুষগুলির সান্নিধ্যে এসেছিলেন। আজও নীরবে এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই দোকানটা।