Ranji Trophy: দিনমজুরের মতো দশা উত্তরাখণ্ডের রঞ্জি দলের ক্রিকেটারদের, দৈনিক তাঁরা পান ১০০ টাকা!
কর্নাটকে রঞ্জি ট্রফির (Ranji Trophy) কোয়ার্টার ফাইনালের পর যে দৃশ্য দেখা গেল ২২ গজে, তা হয়তো কেউ কল্পনা করতেই পারেন না।

জেমি অল্টার
কর্নাটকে রঞ্জি ট্রফির (Ranji Trophy) কোয়ার্টার ফাইনালের পর যে দৃশ্য দেখা গেল ২২ গজে, তা হয়তো কেউ কল্পনা করতেই পারেন না। ৪১ বারের রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন মুম্বইয়ের মুখে কোয়ার্টার ফাইনালে নেমেছিল উত্তরাখণ্ড। রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তরাখণ্ডের বিরুদ্ধে ৭২৫ রানের রেকর্ড ব্যবধানে জিতেছে মুম্বই। মাঠে বিদ্ধস্ত হওয়ার পরও উত্তরাখণ্ডের প্লেয়ারদের জন্য আরও চমক বাকি ছিল। ম্যাচের শেষে গোলটেবলে দেখা যায় উত্তরাখণ্ডের প্লেয়ারদের বিদ্ধস্ত মুখগুলো। তারই মধ্যে উত্তরাখণ্ড দলের এক সিনিয়র ক্রিকেটার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ম্যাচের শেষে গিয়ে হাজির হন দলের সদস্যরা যেখানে বসে ছিলেন, সেই জায়গায়। তিনি জানতেন কী অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য। কিন্তু উত্তরাখণ্ডের প্লেয়ারদের সঙ্গে যে অন্যায় হচ্ছে তা আর চুপ করে সহ্য করতে পারছেন না তাঁরা। উত্তরাখণ্ডের প্লেয়াররা দীর্ঘদিন তাঁদের বকেয়া টাকা পাননি। দলের সিনিয়র প্লেয়ারদের প্রত্যেকের জন্য দৈনিক ১৫০০ টাকা বরাদ্দ ছিল। তারপর তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১০০০ টাকায়। এরপর ফের তা বেঁড়ে গিয়ে হয় ২০০০ টাকা। কিন্তু বাস্তব ছবিটা উত্তরাখণ্ডের প্লেয়ারদের জন্য ভীষণই কষ্টকর। গত ১২ মাস ধরে দৈনিক ১০০ টাকা পান উত্তরাখণ্ডের প্লেয়াররা।
উত্তরাখণ্ড সরকারের তরফে ঠিক করা হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে উত্তরাখণ্ডের যে কোনও অদক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৮০০ টাকা। সেখানে কিনা রাজ্যের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা ক্রিকেটাররা প্রতিদিন গড়ে পান মাত্র ১০০ টাকা করে। যে রাজ্যের প্লেয়াররা রঞ্জির মতো ঐতিহ্যবাহী ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলেন তাঁদের এই বেহাল দশা যে কাউকে ভাবাতে বাধ্য। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট এই বিষয়ে যেন মুখে কুলুপ এটে রেখেছে।
নিজেদের প্রাপ্য অর্থ কবে পাবেন? এই প্রশ্ন নিয়ে যে ক্রিকেটারই টিম ম্যানেজারের কাছে যান, উত্তর পান, ‘কেন বার বার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকো? টাকা পেয়ে যাবে। তার আগে সুইগি-জোম্যাটো থেকে অর্ডার করে ম্যানেজ করে নাও।’
উল্লেখ্য, রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম ইনিংসে সুবেদ পার্কারের দ্বিশতরান এবং সরফরাজ খানের শতরানের সৌজন্যে ৬৪৭-৮ স্কোরে সমাপ্তি ঘোষণা করে মুম্বই। জবাবে উত্তরাখণ্ডকে মাত্র ১১৪ রানে অলআউট করে দেয় মুম্বই। শামস মুলানি ১২ ওভার বোলিং করে ৫ উইকেট নেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৬১-৩ স্কোরে সমাপ্তি ঘোষণা করে মুম্বই। যশস্বী জসওয়াল শতরান করেন। অধিনায়ক পৃথ্বী শ এবং আদিত্য তারে অর্ধশতরান করেন। উত্তরাখণ্ডের সামনে জয়ের লক্ষ্য ছিল ৭৯৫। উত্তরাখণ্ড মাত্র ৬৯ রানেই আটকে যায়। ৭২৫ রানের রেকর্ড ব্যবধানে জেতে মুম্বই। ফলে এ বারের মতো রঞ্জি সফর শেষ উত্তরাখণ্ডের। দলের প্রতিটা খেলোয়াড় যতটা হতাশ, ঠিক ততটাই তাঁরা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। দীর্ঘদিন ধরে উত্তরাখণ্ড ক্রিকেটকে জাপটে রেখেছে ট্রায়ালে ভেদাভেদ, আর্থিক কারচুপির মত ঘটনা।
একাধিকবার উত্তরাখণ্ডের প্লেয়াররা এই নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কোনও লাভ হয়নি। একাধিক সাক্ষাৎকারের সময়, দুর্নীতি, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এবং আর্থিক অপব্যবহারের স্পষ্ট প্রমাণ উঠে এসেছে। এছাড়াও বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও উঠেছে অভিযোগ।
উত্তরাখণ্ড ক্রিকেটে অ্যাসোসিয়েশনের কর্মী নিয়োগেও ফাঁকফোকর রয়েছে। একজন কোচকে একই দিনে সিএইউ এর পক্ষ থেকে দুটি আলাদা নিয়োগপত্র পাঠানো হয়েছিল। তিন দিন পরে, তাঁকে আরও বেশি পরিমাণ বেতন উল্লেখ করে আরেকটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল, যেটিতে সিএইউ-এর সচিবের স্বাক্ষর ও ছিল। সিএইউ এর এক সদস্য বলেন, “একটি পেশাদার জায়গায়, যদি কেউ চাকরির জন্য আবেদন করে, তবে তাদের প্রমাণপত্র পেশ করতে হবে, তাই না? উপযুক্ত অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণপত্রাদিসহ একটি আবেদন দেখার পরেই একজন প্রার্থীকে ডাকার কথা। কিন্তু এখানে কোনও শংসাপত্র চাওয়া হয় না। নিয়োগ করা হয় বন্ধুত্ব এবং ভালো যোগাযোগ থাকলে।”
২০২০ সালে সিএইউএর পক্ষ থেকে যে প্লেয়ারদের পেশাদার হিসেবে খেলার জন্য সই করানো হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছেন উত্তরাখণ্ডের অধিনায়ক জয় বিস্তও। চার দিনের এবং ওয়ান ডে টুর্নামেন্টের জন্য সিনিয়র দলের অধিনায়ক তিনি। বিসিসিআইয়ের কাছে এই ইস্যুতে তিনি এক চিঠি জমা দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, উত্তরাখণ্ডের যে সকল প্লেয়ারদের তাঁদের প্রাপ্য অর্থ বকেয়া রয়েছে, তা যে ক্লিয়ার করে দেওয়া হয়।
বিস্তা এখনও বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে উত্তর পাননি। কিন্তু বোর্ডে তাঁর সেই ইমেলটি পাঠানোর এক সপ্তাহ পরে তিনি ২৮০০ এবং ২৭০০ টাকার দুটি ব্যাঙ্ক লেনদেন লক্ষ্য করেন। যখন তিনি উত্তরাখণ্ড টিম ম্যানেজারের কাছে এই লেনদেনের বিষয়ে জানতে চান, তখন বিস্তাকে বলা হয়েছিল, যে এইগুলি দৈনিক ভাতার বকেয়া যা সিএইউ বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে পেয়েছে।
বিস্তা এ ব্যাপারে বলেন, “আমি বুঝতে পারিনি তিনি কী বলতে চেয়েছেন। কারণ আমরা ৩৫ থেকে ৩৬ দিন বিজয় হাজারে ট্রফি ও সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফির জন্য ট্র্যাভেল করেছি। তাই পাঁচ হাজার টাকা কী করে এই জন্য সঠিক বরাদ্দ হতে পারে। কোনও রাজ্য অ্যাসোসিয়েশন তাদের প্লেয়ারদের দীর্ঘদিন ধরে এই ধরণের ডিএ দেয় না।”
বিস্তা আরও জানান, তিনি যখন তাঁদের দলের ম্যানেজারের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলেন, তিনি তাঁকে জানান মহামারির কারণে এভাবে প্লেয়ারদের প্রাপ্ত অর্থ বকেয়া রয়েছে। বিসিসিআই অ্যাসোসিয়েশনকে যে পরিমাণ অর্থ দেয়, তার থেকে তারা প্লেয়ারদের মধ্যে সেই অর্থ ভাগ করে দেয়। এমনটাই বিস্তাকে জানান তাঁর দলের ম্যানেজার। তবে বিস্তা অন্যান্য রাজ্যের প্লেয়ারদের যাঁরা তাঁর বন্ধু, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, তাঁরা সঠিক পরিমানেই ডিএ পাচ্ছেন। বিস্তা বেশি অবাক হন তিনি বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে কোনও উত্তর না পাওয়ার জন্য।
উত্তরাখণ্ডের প্লেয়ারদের যে খাবার দেওয়া হয়, সেই খাবারের মানও ভালো নয়। এমনটাই জানান বিস্তা। পাঁচতারা হোটেলে প্লেয়াররা থাকলে তাঁদের খাবারের জন্য নিজের পকেট থেকে টাকা খসে। প্রাপ্য ডিএ না পাওয়ায় যা রীতিমতো সমস্যায় ফেলে প্লেয়ারদের।
উত্তরাখণ্ডের একজন সিনিয়র খেলোয়াড়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, তিনি বলেন, “সিনিয়র পুরুষদের উত্তরাখণ্ড দলের বর্তমান কোচ মাত্র ছয়টি প্রথম-শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। যেখানে অনূর্ধ্ব-২২ কোচ ১২০টি ম্যাচে খেলেছেন। এবং একজন খেলোয়াড় হিসেবে অনুর্ধ্ব-১৯ এর কোচ ৭০টি ম্যাচে খেলেছেন।”
উত্তরাখণ্ডের প্লেয়াররা এবং তাঁদের অভিভাবকরা রাজ্যের অ্যাসোসিয়েশনের এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাধিকবার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। কিন্তু আদতে কোনও লাভ হয়নি। রাজ্যের তরুণ প্রতিভাদের এই দুর্নীতিযুক্ত পরিবেশে কীভাবে বিকাশ হবে? যা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় থাকেন তাঁদের অভিভাবকরা। উত্তরাখণ্ডের এক সিনিয়র অ্যাডমিন্সট্রেটর এ বিষয়ে বলেন, “এই ধরণের সিস্টেম হওয়ার কোনও মানে হয় না। পুরো সিস্টেমটাই দুর্নীতিতে ভরা।”





