TV9 Explained: গর্জে উঠল পারস্য সভ্যতা, হিজাব-মুক্তির দাবিতে জ্বলছে ইরান

Iran Hijab Row : সংঘর্ষে পাঁচ আধাসেনা কর্মীরও মৃত্যু হয়েছে। বিক্ষোভের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইশি।

TV9 Explained: গর্জে উঠল পারস্য সভ্যতা, হিজাব-মুক্তির দাবিতে জ্বলছে ইরান
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 28, 2022 | 5:03 PM

প্রদীপ চক্রবর্তী

আব্রুর গেরোয় বেআব্রু মোল্লাতন্ত্র। নির্মম ধর্মীয় ফতোয়া রেহাই দেয়নি সদ্য-যুবতীকেও। ঠিকমতো হিজাব না পরায় তেরোই সেপ্টেম্বর মাহশা আমিনি নামে এক তরুণীকে গ্রেফতার করে ইরানের নীতি পুলিশ। ষোলোই সেপ্টেম্বর হেফাজতেই মৃত্যু হয় বাইশ বছরের তরুণীর। নির্মম অত্যাচারেই মারা গিয়েছেন মাহশা। অভিযোগ পরিবারের। মাহশার নিথর দেহ যেন জ্বলন্ত দেশলাই। বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ আছড়ে পড়েছে স্তূপীকৃত ক্ষোভের বারুদে। ইরান (Iran) জ্বলছে। তেহরান সহ ছেচল্লিশটি শহর জ্বলছে। ক্যাস্পিয়ান সাগর থেকে পারস্য উপসাগর। আগুন জ্বলছে। 

মোল্লাতন্ত্রের ফতোয়া, মাথার চুলে হাওয়া লাগানো যাবে না। মাথা ঢাকা রাখতে হবে। প্রতিবাদে প্রকাশ্য রাস্তায় মাথায় চুল কাটছেন তরুণী থেকে প্রৌঢ়া। চুল কাটার ভিডিয়ো পোস্ট করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। মাঝ রাস্তায় হিজাব পুড়িয়ে দিচ্ছেন। প্রতিবাদীদের হাতে বিপ্লবের নতুন ধ্বজা। কাপড়ের পতাকা নয়। মাথার চুল কেটে লাঠির ডগায় বেঁধে উড়িয়ে দিয়েছেন মহিলারা। 

ইরানের প্রেসিডেন্ট, ইব্রাহিম রাইশি মাহশার মৃত্যুর কারণ খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু, রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভ ঠেকাতে সক্রিয় পুলিশ। সমান্তরাল সামরিক বাহিনী রেভোলিউশনরি গার্ড সক্রিয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে লাঠি চালানো হচ্ছে। কাঁদানে গ্যাসের সেল ছোড়া হচ্ছে। গুলি চালানো হচ্ছে। নির্বিচারে নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে। মানুষ লুটিয়ে পড়ছেন। আহত হচ্ছেন। প্রায় বারোশো বিক্ষোভকারী গ্রেফতার হয়েছেন। স্পর্শকাতর এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ থামছে না। একজন সরতেই অন্যজন তাঁর ধ্বজা তুলে নিচ্ছেন। 

সংঘর্ষে পাঁচ আধাসেনা কর্মীরও মৃত্যু হয়েছে। বিক্ষোভের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইশি। সরকার এর পিছনে পশ্চিমী ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছে। মোল্লারা আমেরিকার উস্কানিকে দূষছেন। পশ্চিমী সভ্যতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলির মুণ্ডপাত হচ্ছে। লন্ডনে প্রকাশিত ফার্সি পত্রিকার কভারেজের জন্য ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সতর্ক করেছে তেহরান। নরওয়ের পার্লামেন্টের অধ্যক্ষ বিক্ষোভকে সমর্থন করায়, সেদেশের রাষ্ট্রদূতকে কড়া কথা শোনানো হয়েছে। অন্যদিকে, নাগরিকদের ওপর নির্যাতন করায়, ইরানকে আরও কঠোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মুখে ফেলার কথা ভাবছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। 

অথচ এই ইরান একসময় ছিল পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক ও সমৃদ্ধ দেশ। শাহের আমলে পারস্য ছিল পশ্চিমী সভ্যতায় মোড়া। তখন হিজাব বা কোনও ধর্মীয় পোশাক পরলে খুলে দিত পুলিশ। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লব ঘটান ধর্মগুরু আয়াতোল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি। হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করেন তিনি। 

iran

ইরানে বিক্ষোভ

সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, চার দশকের কঠোর অনুশাসনে হাঁপিয়ে উঠেছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। তার ওপর পশ্চিমী বিশ্বের সঙ্গে একটানা সংঘাত। টানা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা। একসময়ের অতি সমৃদ্ধ দেশে জীবনযাপনের মান পড়ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। দারিদ্রের জেরে আপোষ করতে হচ্ছে আত্মসম্মানের সঙ্গে। বিপ্লবের পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরেই তৈরি হচ্ছে। 

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দুহাজার উনিশে বিক্ষোভে নামে মধ্যবিত্ত সমাজ। সেবার মূলত শ্রমজীবী পুরুষরাই রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই বিক্ষোভ কঠোরভাবে দমন করে শাসক। কয়েকহাজার বিক্ষোভকারী মারা যান। সেই বিক্ষোভ দমন করা গেছে। কিন্তু এই বিক্ষোভ দমন করা সহজ নয়। মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এবার ইরানের মানুষ বেপরোয়া। মৃত্যুকেও পরোয়া করছেন না। ধর্মগুরু থেকে রাষ্ট্র। কারও কথা শুনছেন না। এবার প্রায় গোটা নাগরিক সমাজ বিক্ষোভে সামিল। বাইশ বছরের তরুণীকে পিটিয়ে মারা কেউই মেনে নিতে পারছেন না।কেউ প্রত্যক্ষে প্রতিবাদী। কারও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। এই প্রথমবার ইরানে কোনও বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহিলারা। পুরুষরা তাঁদের সঙ্গী। মেয়ের জন্য রাস্তায় নেমেছেন বাবা। স্ত্রীর মুক্তির জন্য রাস্তায় স্বামী। বোনের জন্য ভাই। বান্ধবীর জন্য বন্ধু। প্রেমিকার জন্য প্রেমিক। মায়ের জন্য ছেলে। অতি প্রাচীন সভ্যতা যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। শিল্প অনুরাগী, বিদ্যানুরাগী, মমনশীল সমাজ স্বাধীনতা চাইছে। ভাবনার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা। পোশাকের স্বাধীনতা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হিজাব-মুক্তি চাইছে ইরান।