Drama at Burning ground: শ্মশানে নাটক!

Drama at Burning ground: শ্মশান ভূমির মাঠে নাটক। কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের পরিবারের মানুষগুলো নাটক দেখতে ভিড় জমান। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের এই পিছিয়ে পড়া অজয়ের তীরের গ্রামটিতে এখনও তেমন শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি।

Drama at Burning ground: শ্মশানে নাটক!
শ্মশানেই হয় নাটকের আয়োজন
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Aug 14, 2024 | 4:53 PM

প্রীতম দে

রাধামাধবের কীর্তি। ইটভাটার এক শ্রমিকের সন্তান আউশগ্রামের এক পাগল লেখক রাধামাধব মণ্ডল। গ্রামের শ্মশানে আয়োজন করেন নাটকের। আর এর কাছেই গড়ে তুলছেন তাঁর আশ্রম। যেখানে ভাদু-টুসুর মত নাচগানের আসর বসে।

সেজে উঠছে প্রকৃতিযাপনের নিবিড় আখড়াটি। শ্মশান ভূমির মাঠে, ছায়াময় এমন পরিবেশে এমন আখড়ায় বাংলা সংস্কৃতির এই চর্চাতে আসছেন রাজ্যের নানা স্তরের মানুষ। নাট্যকার মণীশ মিত্রের নাটক দেখতে আসেন আউশগ্রাম থানার আইসি আব্দুল রব খান, ছোড়া থানার ওসি পঙ্কজ নস্কর-সহ স্থানীয় স্কুল কলেজের শিক্ষক, শিক্ষিকারা।

স্তব্ধ ভৌতিক পরিবেশে, মশাল জ্বালিয়ে এই নাটকের আয়োজনে হাতে হাত লাগান গোপালপুর উল্লাসপুরের সহজ আশ্রমের প্রাণপুরুষ লেখক রাধামাধব মণ্ডল-সহ রাখি মণ্ডল, মিতালি কর্মকার, কেশব মণ্ডল, সুভাষ ঘোষ, কালোসোনা মেটে, প্রদীপ ঘোষ, পরিধন কর্মকারসহ আরও অনেকে। দুই গ্রামের কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের পরিবারের মানুষগুলো নাটক দেখতে ভিড় জমান। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের এই পিছিয়ে পড়া অজয়ের তীরের গ্রামটিতে এখনও তেমন শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। অনেক পরিবারের সদস্যরাই প্রথম প্রজন্ম শিক্ষার আলো গায়ে মেখে স্কুলের গণ্ডিতে। এমন গ্রামে লেখক রাধামাধব মণ্ডলের আহ্বানে আলো জ্বালাতে শুরু করেছেন গ্রামের কয়েক জনকে নিয়ে।

গ্রামের মহিলারা সাজিয়ে তুলছেন শ্মশানঘাট

এই প্রথম বাংলা নাটক পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের গোপালপুর উল্লাসপুরের সহজ সেবাশ্রমের শ্মশান কালী মন্দিরের অতীতের ঝিল থেকে। বাংলা নাটকের এই মুহূর্তের প্রথিতযশা নাট্য পরিচালক কসবা অর্ঘ্য’র মণীশ মিত্রের আয়োজনে, এমন গণ্ডগ্রামের শ্মশান ভূমির ফাঁকা মাঠে নাটক। দেখতে এলেন গ্রাম ছাপিয়ে কয়েকশো দর্শক। তার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা ছিল বেশি। আউশগ্রামের এই আশ্রমের প্রথম এই নাটকটির নাম “জাস্ট এন আওয়ার”। যে নাটকের মূল অভিনেতা শুভজিৎ চক্রবর্তী।

নাটকে একটি মৃতদেহ ঝিলে তোলার পর, বলতে শুরু করেন এক ঘণ্টার বক্তব্যমালা। সেই বক্তব্যকেই ভিত্তি করে নির্মিত মণীশ মিত্রের এই নাটক। পরে এই শ্মশানভূমির আশ্রমেই মাটির আসনে মঞ্চস্থ হয় মণীশ মিত্রের দ্বিতীয় নাটক “আধ্যাস”। নির্মিত এই নাটকটি ঘিরে ধর্ম আর অধর্মের বিষয়টি এসেছে। মালায়ালাম কবি ভাইরুপল্লী মেননের কবিতা সায়ান্তে মাকানের অনুপ্রেরণায় অর্ঘ্য’র নাটক আধ্যাস। নাটকের শুরুতে এবং দুটি নাটকের মাঝখানে বাউল গান পরিবেশন করেন বাউল মানস মুখোপাধ্যায় এবং ফকিরিগান পরিবেশন করেন আনসাদ ফকির।

দুটি নাটকের মাঝে বাউল গানের আসর

বাবা ছিলেন ইটভাটার শ্রমিক। অজয়তীরের একটি ইটভাটায় কাজ করতেন আজীবন। ছেলেবেলায় কখনও আহার, কখনও অনাহারে কেটেছে দিন। হাটে কাঁচা সবজিও বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে। হেমন্তের শীতের বেলায়, পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের জন্মগ্রাম গোপালপুরের মাঠে পাকা ধানের শিষ কুড়িয়ে, কুড়িয়ে হয়েছে তার শীত পোশাক। ১১৭৬-এ হারিয়ে যাওয়া সেই গ্রাম গোপালপুর থেকেই শুরু করেছিলেন নিজের জীবন নিয়ে লড়াই। অভাবী লড়াইয়ে নিজেই নাটক লিখেছেন, বই ছাপিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে করেছেন বিক্রি!

তবে নিজের গ্রাম, নিজের ক্ষেতমজুর পাড়ার মানুষজনদের ভিড়ে তিনি খু্ঁজেছেন বাংলার গ্রামীণ লোকজীবনের সংস্কৃতি। বিচিত্র সেই অজয়তীরের গ্রাম তাঁকে শিখিয়েছে বৈচিত্র্যময় বাংলার নানান লোকাচার। যে লোকাচার হারিয়ে রয়েছে এমন গণ্ডগ্রামের মাটিতেই। তাঁর গ্রামে একসময় ছিল মস্ত ডাকাতদলের ডেরা। তাদের পরবর্তী কালের বংশের মানুষজনরাই অভাবী দিনে লেখকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিনে দিয়েছে ভাতের চাল! আজ সেই গ্রামের আলোর পথযাত্রী, লেখক রাধামাধব মণ্ডল। ছেলেবেলার ধুলো উড়িয়ে সেই যে গ্রামীণ খেলায় নিজেকে হারিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলার বিচিত্র সংস্কৃতির সঙ্গে সেখান থেকে আজও তিনি বেরিয়ে আসতে পারেননি। বরং লিখছেন তাদের কথায়। ডাকাতদের গল্প। হেমন্তের গ্রামীণ বৈষ্ণবীয় টহল গানের কথা, বাংলার চোরদের কথা, রাঢ়ের হানাবাড়ি, শ্মশানবন্ধুদের গান, ফসল কাটা, ফসল বোনার গান। বাংলার বিচিত্র রূপের নানান পরিসরই তাঁকে আটকে রেখেছে। এপ্রজন্মের তরুণ, অন্য ধারার গদ্যকার রাধামাধব মণ্ডল নিজের গ্রামীণ জীবনকে নিয়ে গিয়ে তুলেছেন আলোর জগতে। তার টানেই তৈরি হয়েছে নিজের এলাকায় ‘পাণ্ডুরাজা প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্র’। নিজের গ্রামেই গড়ে তুলেছেন মায়াপ্রকৃতির টানে ‘সহজ আশ্রম’।

অজয় নদের তীরে শ্মশানঘাট

আউশগ্রামের রাজা বল্লাল সেনের গড় জঙ্গলকে জাতীয় সংরক্ষণের আওতায় আনার জন্য, তিনিই শুরু করেন আন্দোলন। নদী বাঁচানোর পাশাপাশি, প্রকৃতির উৎসব, বৈচিত্র্যের বাংলাকে তুলে ধরতে তিনি সেখানে বছরভর আয়োজন করেন আলোচনা সভা। তাঁর আশ্রমে হয় আলপনা উৎসব, ভাদু উৎসব, টুসু উৎসব, মাটিপরব, গ্রামমেলা। গ্রামীণ মহিলাদের অংশগ্রহণে সে আশ্রম মুখরিত হয়। হতদরিদ্র পরিবারে জন্মেও লিখছেন নিজের গ্রামে বসেই। আর দেশ বিদেশের কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে সে লেখা। তার বিচিত্র বিষয়ের বইগুলিই তাঁর সম্পদ। পাকমারা, বহুরূপী, তন্ত্রের পাশাপাশি বাংলার উনুন ও উনুন সংস্কৃতি, কালী, দুর্গা, ঢাকিদের নিয়ে, লোকাচার, ফসলপরব আর ডাকাত কালী এবং তুকতাক নিয়েও রয়েছে তাঁর বই। লেখাই রাধামাধব মণ্ডলের একমাত্র জীবিকা।

তিনি প্রতিনিয়ত লড়ছেন জীবনযুদ্ধের মাটিতে একা নয়, তাঁর গ্রামের যৌথ পরিবারকে নিয়ে। ক্ষেতমজুরদের গ্রামে কোনও দুর্গাপুজো ছিল না বলে তাঁর খুব কষ্ট হত। পুজোর ক’দিন গোটা গ্রাম থাকত অন্ধকার। পাশের জমিদারি গ্রামে তখন পুজোর হুল্লোড়। আনন্দের কলতান। লেখকের মন কেঁদেছে। শুধু নিজের জন্য নয়! গোটা গ্রামের জন্যই তাঁর মন কাঁদে। গ্রামের ছেলেরা দল বেঁধে জমিদার বাড়ির পুজো দেখতে গিয়ে, ফিরে এসেছে তাড়া খেয়ে। নীচু জাতের হওয়াতে তাদের হাতে কেউ দেয়নি প্রসাদ। এই কষ্ট বুকে করে নিয়ে ফিরেছেন লেখক। তাই নিজের উদ্যোগে, গ্রামের মানুষদের সহযোগিতায় শুরু করেন পুজো। দুর্গা আসে এখন লেখকের গ্রামেও। সমবেত ক্ষেতমজুরদের দানে। তবে প্রতি বছর পুজোর উদ্বোধন হয়, মানুষের পুজো করে। কোনও বছর কৃষক, কোনও বছর বৃহন্নলাদের পুজো, দেহজীবীদের পুজোও করবেন এবার। লেখক রাধামাধব মণ্ডল তাঁর নিজের চেষ্টায়, শুধু বাংলার পরিচিত গ্রামগুলোর ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছেন। কয়েকটি জেলার গ্রামের ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে। পায়ে পায়ে ঘুরছেন লেখক। বাংলার বাঙালিদের ইতিহাস, অজ্ঞাত ইতিহাসের খোঁজে।

আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)