British Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ১৭, ডাল ফেলে মাছ নিয়ে খিচুড়ির কালাপানি পার

পলাশীর যুদ্ধের ঠিক তেত্রিশ বছরের মাথায় খিচুড়ি হুগলিপাড় থেকে এস্কেপাড়ে পৌঁছে গিয়েছিল পাকাপাকি ভাবে। কী করে পৌঁছল?

British Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ১৭, ডাল ফেলে মাছ নিয়ে খিচুড়ির কালাপানি পার
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jan 01, 2022 | 7:36 AM
নীলাঞ্জন হাজরা 
‘সর-জ়মিন-এ-হিন্দ’-এর সব থেকে বিনম্র, কিন্তু জাতি-ধর্ম-ভাষা-ভৌগোলিক অঞ্চল নির্বিশেষে বিপুল জনপ্রিয় খানা কোনটি? উত্তর একটাই—খিচুড়ি। সেই খিচুড়ি কী ভাবে প্রথমে অস্ত-না-যাওয়া-সূর্যের সাম্রাজ্যের রাজ-হেঁশেল এবং তার পর দুনিয়ার সব থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রপ্রধানের নিবাস হোয়াইট হাউসের রান্নাঘর, মায় সুদূর উত্তর আফ্রিকার মিশরের রাজধানী কায়রোবাসীর মন জিতে নিয়েছে, সে এক দুরন্ত কাহিনী। সত্যি বলতে কী, খিচুড়ির হাজার-হাজার বছরের সফর রোমহর্ষক। সে সফরনামার পাক চলছে আমার হেঁশেলে, আশা করছি আগামী বৈশাখেই পরিবেশন করতে পারব এক্কেবারে আস্ত কেতাবের আকারে। আজ আমরা শুনব তার এক টুকরো—নিজের ভোল পাল্টে খিচুড়ির ব্রিটেন যাত্রা।
সপ্তদশ শতকের শেষের মধ্যেই কালাপানি পার করে ব্রিটেন থেকে ভারত ঘুরে যাওয়া বেশ কিছু মানুষ বিভিন্ন বানানে (!) খিচুড়ি খেয়ে তার পাকপ্রণালী দেশে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এবার প্রশ্ন হল, এর অর্ধশতক পরে পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীন ভারতীয় ভাগ্যসূর্য অস্তমিত হওয়ায় যখন সাহেবরা দলে-দলে এসে কলকাতাকে নগর করে তুলে সেখানে ভিড় করতে লাগলেন, তার কত বছর পরে কালাপানি পেরিয়ে খাস সাহেবদের হেঁশেলে খিচুড়ি ‘কেজরি’ (Kedgeree) নামটি নিয়ে, ডাল ফেলে মাছ নিয়ে, পাকাপাকি ভাবে ঢুকে পড়ল?
সে কাণ্ডটা যে কী স্পিডে ঘটেছিল, খুঁজতে-খুঁজতে তার এক পরমাশ্চর্য প্রমাণ মিলে গেল স্কটল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থাগারের ওয়েবসাইটে সযত্নে রক্ষিত এক কুকবুকের পাণ্ডুলিপিতে। রঙ চটা চৌকো বাঁধানো খাতা। ওপরে, যেন একটু অজত্নেই কালচে কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা BURNFOOT। ঠিক তার নীচে বাঁকা ভাবে নীল কালিতে 1790। পাতা ওল্টালে ভের্সোর একেবারে ওপরে কালো কালিতে টানা সুন্দর হাতে লেখা— Kharmothi Powder sold by Grimode Chemist and Druggist 122 Pall Mall। তার নীচে একটা বাক্য যেটা আমি পুরোটা উদ্ধার করতে পারিনি। তার নীচে ডান দিক করে কালো কালিতে প্রথমে সই স্টেফানা ম্যালকম, এবং কালি শুকানোর আগেই সেটা ধ্যাবড়া কিছু দিয়ে মুছে দেওয়া। তার নীচে নীল কালিতে সই স্টেফানা ম্যালকম। তারও নীচে বার্নফুট। প্রায় নিশ্চিত, সই ও বইয়ের লেখা ভিন্ন মানুষের। পাণ্ডুলিপি নির্ঘাত অন্য কারও সুন্দর টানা হাতে কপি করা।
প্রশ্ন হল, কে এই স্টেফান ম্যালকম? স্যার জর্জ ম্যালকম ও তস্য স্ত্রী মার্গারেট ম্যালকমের কন্যা। কে জর্জ ম্যালকম? আশ্চর্য ইতিহাস এই ম্যালকম পরিবারের। একেবারে দক্ষিণ স্কটল্যান্ডের সবুজ প্রান্তর আর গড়গড়ানো টিলায় ভরা যে অঞ্চল স্কটিশ বর্ডার্স নামে পরিচিত, তার এক প্রত্যন্ত গ্রাম এস্কাডেল, এস্কেডেল উপত্যকায়। এই এস্কাডেলে এখন একটা এস্টেটে চলে এক হলিডে রিসর্ট, অনেকগুলো কটেজ নিয়ে। এই এস্টেটেই একদিন ছিল ম্যালকম পরিবারের বাস। সে এস্টেটের নাম বার্নফুট হাউস।
বর্তমান ল্যাঙ্গহোম শহর এস্কে নদীর পাড়ে। তা থেকে নদীপাড় ধরে আর মাইল চারেক উপরের দিকে উঠে গেলে যে এস্কাডেল উপত্যকা যদ্দূর চোখ যায়, তা অষ্টাদশ শতকে ছিল বাকেলিউট ডিউকদের সম্পত্তি। ১৭৩০ সালে এরই মধ্যে অবস্থিত বার্নফুট এস্টেট নামমাত্র অর্থে ডিউক পরিবার ভাড়া দেন পাদরি রবার্ট ম্যালকমকে। যাতে ‘মিনিস্টার’ হিসেবে তাঁর যা উপার্জন, এই এস্টেটে খামার চালিয়ে তা কিছু বাড়ে। খামারের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। নদীর ওপারে আর এক খামার ক্রেগ এস্টেট। সে খামারে জেম্স প্ল্যাসি পরিবারের বাস। বছরের প্রায় পুরো সময়টাই ঝিরিহিরি এস্কে নদী আধা সাঁতরে, আধা হেঁটে পারাপার করা যেত সহজেই। সাঁকো ছিল না, তার দরকারও ছিল না সেই গ্রামীণ জীবনচর্যায়। ম্যালকম ও প্ল্যাসি পরিবারের বাচ্চাদের সময়ে অসময়ে প্রাণ খুলে হইচইয়ের জায়গা ছিল এস্কে নদীর দুই পাড়।
হইচই করতে-করতেই বড় হয়ে উঠছিল রবার্ট ও অ্যাগনেসের এক পুত্র জর্জ এবং জেম্স ও ম্যাগডালেনের কন্যা মার্গারেট। জর্জের জন্ম ১৭২৯ সালে, আর মার্গারেটের ১৭৪২-এ। তেরো বছরের ছোট বড় হলেও কখন যে কোন হইচইয়ের মুহূর্তে সে চোখাচুখি হয়ে গেল, তার ইতিহাস কেউ লেখেনি। কিন্তু বিয়েটা হয়েই গেল ১৭৬১-তে।
জর্জ ভেবেছিলেন তিনি বাবার মতোই পাদরি হবেন। বাধ সাধল তাঁর সামান্য তোতলামো। পাদরিদের তো ক্রমাগত লম্বা লম্বা ‘সারমন’ বক্তৃতা দিতে হয়। মুশকিল। তাই খামারে চাষাবাদ আর ভেড়া পালন করেই দিন গুজরানের পথ নিলেন জর্জ। খামার থেকে উপার্জন মোটেই তেমন হচ্ছিল না। শেষে তরিবৎ করে ওয়াইন তৈয়ার করার ব্যবসা শুরু করলেন জর্জ। কিন্তু তা-ও মার খেতে-খেতে শেষে বন্ধ হয়ে গেল ১৭৮০ সালে, ততদিনে রীতিমত দেনায় জড়িয়ে পড়েছেন জর্জ।
সমাজ ও অর্থনীতি ম্যালকম দম্পতির ওপর যতটা কঠোর হয়েছিল, ততটাই উদার ছিল প্রকৃতি। ফলত, তাঁদের সন্তানের সংখ্যা হল সতেরো—দশ পুত্র ও সাত কন্যা। এঁদের অনেকেই অবশ্য প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাঁচেননি। কিন্তু যে পুত্ররা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে চার-চার জন চাকুরিক্ষেত্রে বিপুল খ্যাতি অর্জন করে নাইটহুড উপাধি পেয়েছিলেন: লেফট্যানান্ট কর্নেল স্যার জেম্স ম্যালকম, অ্যাডমিরাল স্যার পাল্টেনি ম্যালকম, স্যার জন ম্যালকম, ভাইস অ্যাডমিরাল স্যার চার্লস ম্যালকম। এঁদের বোন স্টেফানা ম্যালকম জন্মেছিলেন ১৭৭৪-এর ৩১ জানুয়ারি। কাজেই হিসেব করলে দেখা যাবে আমাদের কাহিনিতে অতি মূল্যবান কুকবুকটির পাণ্ডুলিপি শেষ করে তিনি যখন সই করে দিলেন, তখন তিনি স্কটল্যান্ডের এক অন্তিম প্রান্তের ছোট্টো গ্রামের কোনও মতে চলা খামারের ষোড়শী! সালটা ১৭৯০। ঝিরিহিরি এস্কে নদীতীরের থেকে বহু-বহু দূরে প্রবল হুগলি (হ্যাঁ তখন প্রবলই ছিল, ফারাক্কা বাঁধের সব্বোনাশ তখন ঘটেনি, তরতরিয়ে জাহাজ চলত) নদীপাড়ের শহর কলিকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ব্রিটেনের নয়া কলোনি চালাতে ব্যাস্ত ‘গভর্নর জেনারেল ও কমান্ডার ইন চিফ’ চার্ল্স কর্নোয়ালিস।
এই দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগের খোঁজে আমাদের সেই পাণ্ডুলিপিতে ফিরে যেতে হবে। তার প্রথম রেক্টোর এক্কেবারে ওপরে লেখা—Index to the old Book. Date 1790। তারপর ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে একের পর এক পাণীয় ও একটু পরে খাবারের নামের তালিকা। পরবর্তী আট পাতা ধরে তালিকা চলার পর নবম পৃষ্ঠায় পেয়ে যাই প্রথম রেসিপি—Mince Pie Meat! এই তালিকা ধরে চলতে-চলতে সপ্তম পৃষ্ঠায় এসে আমাদের চোখ আটকে যাবে—Kedgeree 69! এই উনসত্তর নম্বর খানাটি মিলল সত্তর নম্বর পাতায়। এক্কেবারে ওপরে ছোট্ট রেসিপি— গুজ়বেরি জ্যাম — নিউ ওয়ে। তারপরেই Kedgeree a breakfast dish। হুবহু তরজমায় সে রেসিপি এ রকম —
কেজরি
একটা বড়সড় হ্যাডক মাছ, কিংবা একটু কড, সিদ্ধ করে ঠাণ্ডা করে কিমা করে নিন। তার সঙ্গে যোগ করুন চারটি শক্ত করে সিদ্ধ করা ডিম, তা-ও কিমা করে, একটা বড় চায়ের কাপ ভর্তি চাল ভাল করে সিদ্ধ করে ফ্যান গেলে সুন্দর করে শুকিয়ে নিন, একটা স্ট্যু-প্যানে ডিমের মাপের এক টুকরো মাখন গলিয়ে নিন, তাতে দিয়ে কিমাগুলোকে খুব গরম করে নিন, তার সঙ্গে হালকা করে ভাত মেশাতে থাকুন, নুন আর একটু লাল লঙ্কা দিন, এবং একটা থালায় হাল্কা চূড় করে পরিবেশন করুন।
কাজেই পলাশীর যুদ্ধের ঠিক তেত্রিশ বছরের মাথায় খিচুড়ি হুগলিপাড় থেকে এস্কেপাড়ে পৌঁছে গিয়েছিল পাকাপাকি ভাবে। কী করে পৌঁছল? কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু একটা প্রায়-নিশ্চিত সম্ভাবনা আছে—তাঁর ভাইয়েরা। দু’জন ভারতে হাজির হয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে এবং আরও দু’জন এসেছিলেন ব্যবসা জমাতে। নয়া উপনিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও লুটের হিড়িকে তখন দলে-দলে ব্রিটিশ জাহাজের পর জাহাজে এসে ভিড়ছেন হুগলির ঘাটে। আর এই ভাইদের মধ্যে সব থেকে ডাকসাইটে নাম হয়েছিল জনের—স্যার জন ম্যালকম। জন সাহেবের জন্ম ১৭৬৯ সালে। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে দেশগ্রাম ছেড়ে, কালাপানি পার করে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ সেনায় যোগ দিতে চলে আসেন তিনি। টানা এগারো বছর। শরীর ভেঙে যায়। এক বছর দেশে কাটিয়ে ফের হিন্দুস্তান। জন সাহেবের দুরন্ত জীবনী আমাদের এ কাহিনির ফ্যাকড়া মাত্র, কাজেই আপাতত শুধু এইটুকুই যে ১৮২৭ সালে তিনি হয়ে যান বম্বের গভর্নর। সতিদাহ প্রথা-রোধ আন্দোলন ও ভারতীয়দের কোম্পানি প্রশাসনের দায়িত্বশীল উঁচু পদে নিয়োগের কট্টর সমর্থক ছিলেন জন।
এ হেন ভাইয়ের মাধ্যমে আর পাঁচটা ভারতীয় আদবের সঙ্গে খিচুড়ির রেসিপিও যে ষোড়শী স্টেফানার হাতে পৌঁছে গিয়েছিল এমনটা কল্পনা করে নিতে আমার অন্তত কোনও অসুবিধে হয়নি। এরপর আর খুব বেশিদিন বাঁচেননি জন। প্রয়াত হন ১৮৩৩ সালে। পিকাডেলির সেন্ট জেম্স চার্চে শায়িত আছেন। স্টেফানা মারা যান এর বহু বছর পরে—১৮৬১-র ২৬ নভেম্বর, ৮৭ বছর বয়সে।
কিন্তু আমাদের এই কিস্সার নিরিখে ১৭৯০ আর ১৮৬১-র মধ্যে একটা মোক্ষম পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। ১৮৩৭ সালের ২০ জুন ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের রানী হয়ে গেলেন আলেকজান্ড্রিনা ভিক্টোরিয়া। টানা ৬৩ বছর সাত মাস। ভিক্টোরীয় যুগ বহু অর্থেই ব্রিটিশ সমাজে ও সংস্কৃতিতে যুগান্তকারী। তার মধ্যে দু’টি আমাদের খিচুড়ি কিস্সায় অপরিহার্য—হিন্দুস্তান এই প্রথম চলে এল ব্রিটিশ রানিপ্রাসাদের একেবারে কেন্দ্রস্থলে। এমনই কেন্দ্রস্থলে যে ১৮৭৬ সালে সব প্রথা জলাঞ্জলি দিয়ে, ব্রিটিশ প্রজাতান্ত্রিকদের তেলে বেগুনে জ্বলিয়ে ব্রিটিশ সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রানি ভিক্টোরিয়াকে খেতাব দিয়ে দিল—Empress of India, ভারতের মহারানি! ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বিশেষত স্বামী অ্যালবার্টের প্রভাবে ভিক্টোরিয়ার কাছে ভারত হয়ে উঠেছিল এক বিপুল অনবদ্য তুলনাহীন উপহারের মতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো স্রেফ লুটের দেশ নয়। ধ্রুপদী রাজতন্ত্রের সংজ্ঞায় ভারতকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করে, পদলহনকারী বসংবদ প্রজাদের স্নেহের ছোঁয়ায় লালন করে, এ দেশটাকে গভীর কৌতুহলে অনুধাবন করে অন্য সব উপনিবেশের থেকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া। ন্যূনতম ছুতোয় তাঁর ভারতীয় প্রভুত্বের বল্গাহীন উদযাপন ‘খাঁটি’ সাহেবরা কিছুতেই হজম করতে পারছিলেন না। ১৮৮৭ সালে গোল্ডেন জুবিলিতে ভারতীয় রেজিমেন্টের মহাজৌলুস যদি বা মেনে নেওয়া গিয়েছিল, ঠিক তার পরেই ‘মহারানি ভিক্টোরিয়া’ চব্বিশ বছরের ‘ভৃত্য’ আব্দুল করিমকে আগ্রা থেকে সোজা অন্দরমহলে আনিয়ে যে কাণ্ডটা করেছিলেন, তা নিয়ে আজও সিনেমা হয়ে চলেছে। তদুপরি রানির প্রিয় গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ওসবোর্নে বিশেষ ভাবে তৈরি হল এক বিপুল চোখ-টেরিয়ে-দেওয়া হলঘর যার সব কিছু ভারতীয়—দরবার রুম। ব্রিটেনের রানিনিশ্বাসে ভুরভুর করতে লাগল হিন্দের গন্ধ। সেই গন্ধের কিছুটা অন্তত যে প্রসাদের হেঁশেলকেও মাতোয়ারা করবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে।
আর রানি ভিক্টোরিয়ার সময়ে খাওয়া-দাওয়া ব্যাপারটাই এক মহোৎসব। এমনই তার বাড়াবাড়ি যে বিখ্যাত ব্রিটিশ খাদ্য-ইতিহাসকার অ্যানি গ্রে একখানা আস্ত কেতাবই লিখে ফেলেছেন, যার নাম ‘The Greedy Queen: Eating With Queen Victoria’। যে কোনও সাম্রাজ্যেই সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর প্রাসাদের হেঁশেল এক মহা কাণ্ডকারখানা। বাদশা-বেগমের নিজের পরিবার, তাঁদের দেখভালে নিযুক্ত দলে-দলে আধিকারিক ও তাঁদের পরিবার, এবং প্রাসাদের অধঃস্তন কর্মচারীদের প্রত্যেক দিনের বিবিধ স্বাদের, বিবিধ শ্রেণির খানা ছাড়াও ছিল প্রসাদের অতিথিদের আপ্যায়নে পরিবেশিত খাবার এবং হরবখত লেগে থাকা উৎসবের খাবার। পুরোদস্তুর এক একটি পাকোয়ান কারখানা। খাবার-দাবারে একেবারে আগ্রহহীন মহামতি জালাল-উদ্দিন আকবর বাদশার হেঁশেলের যে বর্ণনা দিয়েছেন আবু’ল ফজ়ল, তেমন মাথা-ঘুরিয়ে-দেওয়া ব্যাপার না হলেও, অ্যানি গ্রে ভিক্টোরিয়ার হেঁশেলের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা-ও রোমহর্ষক—মাংস আসত বিশেষ বরাত দেওয়া কসাইয়ের কাছ থেকে। ১৮৩৭-এর ২০ জুনের পরের দু’সপ্তাহে মাংসের প্রধান বিক্রেতা জে. আর্মফিল্ড প্রাসাদে পাঠিয়েছিলেন প্রায় ৪০০০ পাউন্ড (১৮১৫ কে.জি.) বড় গরুর বিফ, ২৫০০ পাউন্ড (১১৩৩ কে.জি.) বড় ভেড়ার মাংস (মাটন), ৪০০ পাউন্ড (১৮২ কে.জি.) কচি ভেড়ার মাংস (ল্যাম্ব), ২০০০ পাউন্ড (৯০৭ কে.জি.) কচি গরুর মাংস (ভিল), ২০০ পাউন্ড (৯০ কে.জি.) স্যুয়েট (চর্বি), ৩৬টি বাছুরের কলিজা, তিনটি বাছুরের মাথা, বাছুরের ২০৪টি পায়া, ১২টি কচি ভেড়ার পায়া, বাছুরের ২৮টি গর্দান (সুইটব্রেড), ৭ কোয়ার্টার (৮৮ কে.জি.) বাড়িতে বড় করা ভেড়ার মাংস, ১০টি ভেড়ার গর্দান, তিনটি ষাঁড়ের লেজ এবং চারটি বাছুরের ভেজা, মানে মস্তিষ্ক। এ শুধু বড় প্রাণীর মাংস। হরেক কিসিমের পাখির কথা বাদই দিলাম।
চিফ কুক হয়ে এ হেন কিচেন সামলাতে হত যে সব মস্তান পাচককে, ভিক্টোরিয়ার আমলে তাঁদের মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত ছিলেন কিংবদন্তি শেফ চার্ল্স এমে ফ্রাঙ্কাতেলি, ইতালিয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। এটা আমাকে বেশ অবাক করে। কারণ ফ্রাঙ্কাতেলি ব্রিটিশ রাজন্যের খানা পাকিয়েছিলেন মেরে কেটে দু’ বছর—১৮৪০-এর ৯ মার্চ থেকে ১৮৪২-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি ‘চিফ কুক’ নিযুক্ত ছিলেন খাতায়-কলমে। কিন্তু তার মাস তিনেক আগে এক কাণ্ড ঘটিয়ে সাসপেন্ড হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষকে মানুষ পদবাচ্য মনে করতেন না। যাকে তাকে যখন তখন অপমান করে ঝগড়া বাধাতেন। শেষে ১৮৪১-এর ডিসেম্বরে এমন তাণ্ডব করেন যে ঝগড়া মেটাতে পুলিশ ডাকতে হয়। পুলিশ আসার আগেই তিনি আক্ষরিক অর্থেই চম্পট দেন। আর ফেরেননি। অথচ আজও নাকি তাঁর রান্নার সুবাস উইন্ডসর, বাকিংহ্যাম আর বালমোরালের হেঁশেলে ঢুকলে পাওয়া যায়।
খানা খানদানি-পর্ব ১৮ প্রকাশিত হবে কাল, রবিবার। তারপর বিরতি আবার ফিরে আসার আশায়।
গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভিজিৎ বিশ্বাস