নদিয়া: ছোট্ট অস্মিকা। নামের মাধুর্য্য রেখে আক্ষরিক অর্থেই যেন চাঁদপানা মুখ। গোল গোল চোখ করে যখন তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে, প্রাণ ভরে আসে! আর অস্মিকা শুধু এতটুকুই পারে! এই তো, দু’দিন আগে অস্মিকার এক বছর বয়স হল। কেকও কাটল মায়ের হাত ধরে। নাহ, বলা ভালো, মা তার হাত ধরে কেক কাটাল। একমাত্র মেয়ের প্রথম জন্মদিন, বাবা-মায়ের তো উচ্ছ্বাসের আত্মিহারা হওয়ার কথা! নাহ, তেমনটা হলেন না। বরং তাঁদের চোখে জল। অস্মিকা যত বড় হচ্ছে, বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করছে ওঁদের। রাতে চোখের পাতা এক করতে পারেন না দুশ্চিন্তায়। আর দিনে ঘুমন্ত অস্মিকার মুখ দেখলে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। হাতে আর সময় মাস ছয়েক। সেই সময়ের মধ্যেই যে অস্মিকাকে একটা ইঞ্জেকশন দিতে হবে। না, আর পাঁচটা ভ্যাক্সিন নয়, ১৬ কোটি মূল্যের একটা ইঞ্জেকশন। আর যেটা না দিতে পারলে, অস্মিকা সত্যিই আর পারবেন না উঠে বসতে, নড়াচড়া করতে কিংবা হাঁটাচলা তো দূরের কথা! এক বছরের অস্মিকা এই বয়সেই অসম লড়াইয়ে নদিয়ার রানাঘাটের অস্মিকা দাস। বাবা মায়ের আদুরে মেয়ে এক বিরল রোগের সঙ্গে যুক্ত করছে। ছোট্ট শরীরে বাসা বেঁধেছে বিশ্বের অন্যতম জটিল বিরল রোগ স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (SMA) টাইপ ওয়ান।
যে বয়সে শিশুরা হাঁটতে শেখে, সেই বয়সে ছোট্ট অস্মিকা নিজে থেকে এক ফোঁটাও নড়তে পারে না। কিন্তু অস্মিকা যে এই বিরল রোগে আক্রান্ত, কীভাবে বুঝতে পারলেন তাঁরা?
অস্মিকার মা লক্ষ্মী সরকার দাস বলেন, “ও তিন মাস বয়স পর্যন্ত বাকি বাচ্চাদের মতোই ঠিক ছিল। পা তুলত, হাত নাড়াত। সাড়ে তিন মাস বয়স যখন হল, তখনই হঠাৎ একদিন দেখলাম পা-টা আর তুলছে না। তিন-চার মাসের বাচ্চাদের ঘাড় শক্ত হয়ে যায় সাধারণত। উবুড় হয়ে যায়। কিন্তু ওর কিছুই হচ্ছিল না।”
এরপরই শুরু হয়ে যায় ছোটাছুটি। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে শুরু হয় চিকিৎসা। জটিল এই রোগের চিকিৎসা নদিয়াতে হয় না। তাই কলকাতা থেকে চেন্নাই হয়ে বেঙ্গালুরু যেতে হয়েছে তাঁদের। ছোট্ট অস্মিকাকে সুস্থ করে তুলতে একাধিক হাসপাতালে ছুটেছেন বাবা-মা।
অস্মিকার বাবা শুভঙ্কর দাস বলেন, “প্রথমে ওকে মুকুন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতালে দেখানো হয়। ওখান থেকে ডাক্তারবাবু কিছু পরীক্ষা করাতে দেন। SMN জিন টেস্ট করানো হয়। রিপোর্ট আসে ২০ দিন পরে। ডাক্তারবাবুই বলে দেন, এটা একটা বিরল রোগ। এর চিকিৎসা ভারতবর্ষে নেই। আর যে চিকিৎসা রয়েছে, সেটা কোটি কোটি টাকা খরচ। এরপর ভেলোরে যাই।”
স্পাইনালের অন্যতম জটিল রোগ। অস্মিকার চিকিৎসক সংযুক্তা দে বলেন, “স্পাইনাল মাসকুলার অট্রোফি একটা জেনেটিক ডিসঅর্ডার। জিনগতভাবে হয়। নার্ভ ও পেশীকে এফেক্ট করে। হাতপায়ের নার্ভ ও পেশী শিথিল হতে থাকে। দু’বছরের নীচের বাচ্চাদের জন্য লাইসেন্সড রয়েছে এই ইঞ্জেকশনের। এটিকে একটা অরফান ড্রাগ বলা যেতে পারে। সেটা জিন থেরাপি। অর্থাৎ ‘Onasemnogene‐abeparvovec’। এটা শরীরে একবার ইঞ্জেক্ট করতে হয়।”
এই ইঞ্জেকশন কী করে? চিকিৎসক জানান, “এই ওষুধ শরীরে মধ্যে গিয়ে ওই যে ডিফেক্টিভ জিন, যেটা প্রোটিন তৈরি করতে পারে না, সেই প্রোটিনটা আবার তৈরি করতে সেলকে সাহায্য করে।”
এই ইঞ্জেকশন এখানে পাওয়া যায় না। ইমপোর্ট করতে হয়। ইঞ্জেকশনের দাম ৯ কোটি। কিন্তু কর-আমদানির খরচ-সহ সব মিলিয়ে ১৬ কোটি টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে।
১৬ কোটি টাকার একটা ইঞ্জেকশন! আর হাতে মাত্র পাঁচ ছেকে ছ’মাস। মেয়েকে সুস্থ করতে তুলতে আম জনতার দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছে দাস পরিবার। ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসার খরচ তোলার চেষ্টা করছেন শুভঙ্কর-লক্ষ্মীরা। ইতিমধ্যেই সাহায্য় করেছেন কৈলাশ খের, কনসার্ট করতে এসে অস্মিকার চিকিৎসার খরচ দিয়েছেন। সাহায্য করার কথা বলেছেন রূপম ইসলাম।
অস্মিকার বাবা বললেন, “এটাই শুধু চাই সক্কলকে, আমার মেয়েটা যাতে বেঁচে থাকতে পারে। আমার মেয়েটা যাতে সুস্থ বাচ্চার মতো বড় হতে পারে!” এগিয়ে আসুন আপনারাও…. বিন্দু বিন্দুতেই যে সিন্ধু হয়!